আসামে শত শত ভারতীয়কে বিদেশি বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে prothomalo.com
06, Jun 2025
উত্তর–পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যে হাজার হাজার দরিদ্র এবং প্রধানত শ্রমিক শ্রেণির মানুষ ‘নিদ্রাহীন’ রাত কাটাচ্ছেন। কারণ, শত শত ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি বলে আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে (বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’) দেওয়া হয়েছে।
ভারতের মুম্বাইয়ের নাগরিক সমাজের সংস্থা সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের (সিজেপি) প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী তিস্তা শেতেলবাদের এই সংস্থা জানিয়েছে, আসামের ৩৩ জেলার সর্বত্রই নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে ‘নারী, শিশু ও পুরুষদের’ বেআইনিভাবে আটক করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে।
তবে গত রোববার (১ জুন) ওই সব ভারতীয় নাগরিকের অনেককে বাংলাদেশ থেকে ‘পুশ ব্যাক’ (ফেরত পাঠানো) করা হয়েছে বলেও সিজেপির এই বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামে অন্তত ছয়জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে এই সংস্থাটি।
সিজেপির প্রতিবেদনে যে ছয় নারীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে, তাঁরা হলেন হাজেরা খাতুন, সোনা বানু, রহিমা বেগম, জাহানারা বেগম, আসিফা বেগম ও সাহেরা খাতুন। এই প্রতিবেদন তৈরিতে আসামের বেশ কিছু সাংবাদিক ও সমাজকর্মী অংশ নিয়েছিলেন বলেও জানানো হয়েছে।
সিজেপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৩ মে থেকে হঠাৎ করেই রাজ্যের ৩৩টি জেলায় পুলিশি অভিযান শুরু হয় এবং ‘কোনো নথিভুক্ত মামলা, নোটিশ বা আইনি যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই প্রায় ৩০০ মানুষকে আটক করা হয়।
সাংবিধানিক ও আইনি নিয়ম লঙ্ঘন করে বন্দীদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবার এবং আইনজীবীদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। যদিও প্রায় ১৫০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অসমর্থিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য এখনো আদালতে লড়ছেন, এমন ১৪৫ জনকে জোর করে সীমান্তের ওপারে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
সাংবিধানিক ও আইনি নিয়ম লঙ্ঘন করে বন্দীদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবার এবং আইনজীবীদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। যদিও প্রায় ১৫০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অসমর্থিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য এখনো আদালতে লড়ছেন এমন ১৪৫ জনকে জোর করে সীমান্তের ওপারে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
ভুক্তভোগীর বক্তব্য
বরপেটা জেলার ভাল্লুকি গ্রামের সানসের আলীর স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব হাজেরা খাতুনকে বেআইনিভাবে জোর করে গত ২৫ মে আসাম পুলিশ আটক করে বলে অভিযোগ উঠেছে। অতীতেও তাঁকে একবার আটক করা হয়েছিল এবং তাঁর মামলা এখনো গুয়াহাটি হাইকোর্টে চলছে। তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
এরপরও হাজেরার পরিবারকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তাঁকে আটক করা হয়। ফলে চরম উৎকণ্ঠায় ভুগে তাঁর পরিবার নানা জায়গায় হাজেরার খোঁজ করতে শুরু করেন। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত এই নারীর কোনো সংবাদ তাঁর পরিবার পায়নি বলে সিজেপির সমাজকর্মী ও সাংবাদিক নন্দ ঘোষ এবং আইনজীবী অভিজিৎ চৌধুরী জানিয়েছেন। হাজেরা মে মাসের শেষে বাসায় ফেরার পর তাঁর সঙ্গে সিজেপির প্রতিনিধিরা কথা বলেন।
হাজেরার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর মতো আরও অনেককে তিন–চারটি বাসে করে বরপেটা জেলা থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরে মাটিয়া বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সিজেপির প্রতিনিধিদের হাজেরা বলেন, ‘সারা দিনরাত না খেয়ে এই সময়টা কাটাতে হয়েছে। পরের দিন সকাল ১০টার দিকে…আমরা তখনো বাসে বসে আছি…আমাদের বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সামান্য ভাত দেওয়া হয়। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম, আমরা ঠিকমতো খেতেও পারিনি। এরপর আমরা ভেবেছিলাম, যে ঘরে আমরা ছিলাম, সেখানে কিছুক্ষণ হয়তো বসতে দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডাকা হয় এবং বলে আমাদের ছবি তোলা হবে।’
হাজেরার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর মতো আরও অনেককে তিন–চারটি বাসে করে বরপেটা জেলা থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরে মাটিয়া বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাজেরা সিজেপিকে বলেন, ‘এরপর আমাদের হাতে কিছু বাংলাদেশি টাকা দিয়ে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাস থেকে নামিয়ে বলা হয়, নিজেদের মধ্যে কোনো কথা না বলতে। আমরা চূড়ান্ত অসহায় বোধ করতে শুরু করি। সেখানে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং আমাদের বাধ্য করা হয় সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে।’
এরপর সকালে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি হাজেরা ও তাঁর দলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাঁরা কেন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের সেখানেই রেখে দুই পক্ষের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয় এবং তা চলতে থাকে।
হাজেরা বলেন, ‘দুই দিক থেকে আমাদের একবার এদিকে, একবার ওদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের মধ্যে আলোচনা চলতেই থাকে। কিন্তু আমাদের কী হবে, সে বিষয়ে কোনো সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।’
হাজেরা বিবি সিজেপির প্রতিবেদকদের আরও বলেন, খায়রুল ইসলাম নামের একজন স্কুলশিক্ষক তাঁদের ওপরে এবং বিশেষত নারীদের ওপরে এ ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় তাঁকে এমনভাবে মারধর করা হয় যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একটা সময় পর হাজেরা এবং তাঁর দলকে কেউ বাধা না দেওয়ায় তাঁরা ভারতের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। এভাবে তাঁরা সীমান্ত অঞ্চল থেকে বরপেটা জেলার উদ্দেশে রওনা দেন।
হাজেরার এক ছেলে সিজেপির প্রতিবেদকদের বলেন, ‘৩১ মে রাত ১১টার দিকে আমরা খবর পাই, আমার মা (হাজেরা) এবং সোনা বানু নামের এক নারী গোয়ালপাড়া জেলার মহাসড়কে অবস্থান করছেন। তখন আমি জব্বার ভাইকে (স্থানীয় ছাত্রনেতা) নিয়ে যাই এবং মাকে উদ্ধার করি।’
স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রথম আলোকে এই প্রসঙ্গে বলেন, আসামে এই মুহূর্তে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, কবে তাঁদের দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ে এবং কোনো কথাবার্তা না শুনে বা কাগজপত্র না দেখে তুলে নিয়ে সীমান্তের ওপারে নিরপেক্ষ অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়। নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে এ ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু কখন, কার সঙ্গে ঘটবে, তা কেউ বুঝতে পারছেন না।
আসাম রাজ্যে আগামী বছর নির্বাচন। তার আগে বাঙালি মুসলিমদের ইচ্ছামতো তুলে নিয়ে যাওয়া এবং বিদেশি বলে হেনস্তা করার বিরুদ্ধে আসামের কিছু রাজনৈতিক নেতা ইতিমধ্যে সরব হয়েছেন। তবে এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন।
The original piece may be read here