কোবিদ ১৯ লকডাউন এর মাঝে পরিযায়ী শ্রমিকদের চরম দুরবস্থা আমাদের সামনে রোজ ভেসে আসছে। ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ এই শব্দর পেছনে একজন মানুষ রয়েছেন এবং সেই একজন মানুষ যখন তাঁর যাত্রা, দুরবস্থা, ছোট খাটো আনন্দ, ভয়. বেদনার ব্যাখ্যা করেন, তখন বোঝা যায় এই ভয়াবহ বিভীষিকার আসল চিত্র।
এপ্রিল এ, CJP টিঙ্কু শেখ এবং আরো পাঁচজন পরিযায়ী শ্রমিকদের রেশন দিয়ে সাহায্য করেছিল। আন্তঃরাজ্য যাত্রা শুরু হওয়ার পর, টিঙ্কু নিজের বাড়ি ফিরে যান, পশ্চিমবঙ্গে। তাঁর নিজের ভাষায় তুলে ধরা তাঁর নিজের গল্প।
“আমরা ৬৩ জন, চার দিন চার রাত, একটা ছ চাকার খোলা ছাউনীর লরিতে,” বলছিলেন শেখ, কাপুরবাউড়ি, থানে থেকে রামপুরহাটের নিজের যাত্রার বিবরণ দিতে দিতে। “লরির ভেতরে আমরা পালা করে বসতাম, পালা করে দঁড়িয়ে থাকতাম, রাত্রে এর ওর গায়ের ওপর পরে ঘুমিয়ে নিতাম, আমাদের ব্যাগ মাথার ওপরে একটি দড়ির ওপরে ঝোলানো থাকতো।”
লকডাউনের পরে, বহু পরিযায়ী শ্রমীরা ভয়াবহ মুশকিলের মধ্যে দিয়ে গেছেন। ওঁদের কাছে দুটো বিকল্প ছিল। ব্যয়বহুল শহরে থেকে চরম আর্থিক কষ্টের মধ্যে পরা বা নিজের বাড়ি ফিরে গিয়ে আর্থিক অনিশ্চয়তার সামনাসামনি হয়ে পরা। CJP এদের মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিকদের রেশন দিয়ে সাহায্য করতে পেরেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের জন্য একটা বিকল্প খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব ও আমাদের সকলের। আমাদের ধারাবাহিক ‘পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা‘ এর মধ্যে এমন কিছু শ্রমিকদের নিজের কথা তুলে ধরছি। আমাদের শ্রমিক ভাইবোনদের সাহায্য করতে অনুগ্রহ করে আমাদের দান করুন।
“মুম্বাই তে কাজ করে আমি দিনে ৫০০-৬০০ টাকা রোজগার করি। এখানে বীরভূমে ২০০-৩০০ টাকা রোজগার হয় একই কাজে। মুম্বাই তে কলকাতার চেয়ে বেশি চেনা পরিচিত লোকেরা কাজ করে, তাই ওখানেই যাই। মাসে ১৫-২০ হাজার টাকা রোজগার হলে বাড়িতে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দি। এই লকডাউনে আমার ৩০-৪০ হাজার টাকার লোকসান হয়ে গেলো। কিভাবে আমি এর পরিপূরণ করবো?” শেখের চিন্তা।
এই বছর, ফেব্রূয়ারির ১৯তারিখে শেখ মুম্বাইতে ফেরেন, “কাজ শুরু করতে না করতেই লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেলো, আমরা ছজন গিরগাওঁ এর একটা চাউল এ থাকতাম। পুরো বসে গেলাম। যখন লকডাউন প্রলম্বিত হলো, আমার অনাহারের ভয় পেতে শুরু করলাম, কিচ্ছু খোলা ছিল না, খাবার ও কিছু ছিল না। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চের সামিরুলদা কে যোগাযোগ করলাম। কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা CJP থেকে রেশন পেলাম।”
শেখের CJP র প্রতি এখনো চরম কৃতজ্ঞতাবোধ। “আমি এখনো তিস্তা ম্যাডাম কে ফোন করে ওনার খোঁজ নি। আমি কোনোদিন ভুলবো না ওনারা অসময়ে আমাদেরকে কিভাবে সাহায্য করেছেন।”
লকডাউন সমানে প্রলম্বিত হতে থাকার কারণে, শেখের এবং তাঁর বন্ধুদের বাড়ি ফেরার তাগাদা বেড়ে যায়। “যখন শুনলাম অন্তরাজ্য বাস শুরু হচ্ছে, আমরা পুলিশ থানায় যোগাযোগ করলাম। ওখানে বললো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে এখনো পরিষ্করণ আসেনি। ট্রেন ও নেই, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপর কিছু প্রতিবেশী ধমকাতে লাগলো, বললো আমাদের যদি করোনা ভাইরাস হয় তাহলে সবাইকে মেরে পুঁতে দেবে। খুব ভয় পেয়ে গেলাম।”
চেনা একজন ওদেরকে একটা ট্রাক ভাড়া করার জন্য সাহায্য করেন, “যদি ৬০ জন পেয়ে যাই তাহলে প্রত্যেকের ভাগে ৪২০০ টাকা পড়বে। ৬৩জন পেয়ে গেলাম। লরি ভাড়া করলাম। নাল বাজার থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে গেলাম, যাত্রার দিন। একটা ট্যাক্সি পেলাম, বললো প্রত্যেক যাত্রী কে ১২০০ টাকা দিতে হবে, আমরা মানা করলাম, একটা প্রাইভেট গাড়ি পেলাম, বললো প্রত্যেক যাত্রী কে ৫০০ টাকা দিতে হবে। সেই গাড়ি তে বসে পড়লাম কিন্তু এইরোলি স্টেশনের সামনে পুলিশ সেই গাড়ি থামিয়ে দিলো। আমরা বাকি রাস্তা হাঁটলাম লরি অবধি।”
“আমাদের লরির পিকআপ এখন কাপুরবাউড়ি থেকে। আরেকটা ট্যাক্সি মাথাপিছু ১০০ টাকা নিয়ে আমাদের মাজিওয়াদা তে নামিয়ে দিলো। আরেকটা ট্যাক্সি মাথাপিছু আরো ১০০ টাকা নিয়ে আমাদের কাপুরবাউড়ি তে নামালো। আমরা দুপুর ১২টায় পৌঁছলাম। অনেকে খাবার, জল, বিস্কুট ইত্যাদি বিতরণ করছিলো, আমরা লরির অপেক্ষায় বসে রইলাম। রাত ৩টে তে লরি এলো।”
ভাগ্যক্রমে, পুরো যাত্রায় খাবারের খুব একটা সমস্যা হয়নি, “বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে, সবসময় কেউ না কেউ খাবার বিতরণ করছিলো। শুধু পশ্চিমবঙ্গে কিছু পাইনি। কিছু খোলা ছিল না। পুলিশ দুবার দাঁড় করলো, ওদের সাথে কথা বলার পর আমাদের যেতে দিলো।”
কিন্তু এই চরম ধকলের যাত্রা শুধু শেখেরা করছিলেন না। “অন্য লরি যখন ওভারটেক করছিলো, তাতে লোকে ঠাসা। কত যে লরি, কত লোক! এক্সিডেন্ট এর ভয় হচ্ছিলো।”
সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং এ অবস্থায় বিলাসিতা। “আমরা মাস্কস পরে ছিলাম। আমরা গরীব। ভয়ের বিলাসিতা আমাদের চলে না। তা বলে কি ভয় হয় না? শুধু বড়লোকদের ভয়ের বিলাসিতা করলে মানায়।”
বাংলার বর্ডারে পুলিশ তাঁদেরকে দাঁড় করিয়ে একটা কিষান মান্দি তে জড়ো করলো। “আমাদের টেম্পারেচার নেয়া হলো। নাম, ঠিকানা , আধার নম্বর নেয়া হলো। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখলো শুধু একটু মুড়ি আর জল দিয়ে। আমরা প্রচন্ড রেগে গিয়ে পুলিশের সামনে একটা প্রদর্শন শুরু করলাম। তারপর ওরা আমাদের যেতে দিলো।”
কিন্তু রাজনৈতিক শ্রেণিদের থেকে একটা বিশ্বাসঘাতকতার আঁচ ওঁরা পেয়ে গেছেন। “পুরো যাত্রায় আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলাম যে কেউ আমাদের সাহায্য করলো না, না রাজ্য সরকার, না ভারত সরকার। কোনো রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রী আমাদের হয়ে কথা বললো না, এরকম একটা সময়ে। এতো টাকা খরচ করে বাড়ি ফিরলাম , এতো টাকা লোকসান হলো, চাকরি হারিয়ে গেলো। কে এর ক্ষতিপূরণ করবে? এর জন্য দায়ী কে?”
“আর এখন আর কি? এখানে কোনো কাজ নেই। শুনেছি MNREGA এর কাজ শুরু হয়েছে আমাদের গ্রামে। কিন্তু আমার এখানে চাকরির কার্ড নেই। অফিসগুলো বন্ধ। কি কাজ করবো এখানে? নিজেকে আর পরিবারকে কি করে চালাবো? লকডাউন চলতে থাকলে মানুষ অনাহারে মরবে।” এই বলে টিঙ্কু নিজের কথা শেষ করলেন।